বাওক বাইম

এক আজব মাছ! রাতে নদীর জল ছেড়ে ঢালু পাড় বেয়ে উঠে পড়ে ডাঙায়, কুচকুচ করে খায় খেতের ক্ষীরা ও শসা। খাওয়ার সময় চাপা শব্দ তোলে গলায়, বিপদ বুঝলে গোখরো সাপের মতো ঘাড় ফুলিয়ে আর লেজ দুলিয়ে গলায় তোলে ভয়ংকর আওয়াজ; তীরবেগে নেমে পড়ে আবার জলে। এই মাছটির স্বভাব-চরিত্র নরসিংদীর চরসিন্দুর ইউনিয়নের শীতলক্ষ্যা নদীর পারের মানুষজন ও জেলেরা জানে। জানে বলেই রাতের বেলায় ডাঙা থেকে কেউ কেউ কৌশলে শিকার করে ওদের। এ খবর বাংলাদেশ ওয়াইল্ড লাইফ ক্লাবের চরসিন্দুর শাখার কর্মকর্তা সরওয়ার পাঠানের মুখে শুনি ২০০৪ সালে। সে-ও চেনে মাছটিকে, দেখেছে। জানে স্বভাব-চরিত্রের কথাও। শিহরিত হই আমি। এ তো এক আজব, অলৌকিক মাছ! উত্তেজনায় ভুগতে থাকি। সরওয়ারকে একটি মাছ সংগ্রহ করতে বলি। ২০০৪ সালের ১ ডিসেম্বর একটি মাছ কবজা করে সরওয়ার। মাছটি দেখে প্রথমেই মনে হলো, ওটি কুঁচে। কিন্তু রং-গড়ন-ধরন লক্ষ করে সন্দেহ গভীর হলো। চরসিন্দুরে ওটি ‘বাহক মাছ’ বা ‘বাওক মাছ’ নামে পরিচিত। আবার কেউ কেউ ‘তেলি বাহক’, ‘তেলপোমা’ নামেও ডাকে। কারণ, একেবারে তেলতেলে শরীর। দৈর্ঘ্য ৩৭ সেন্টিমিটার, ঘাড়ের বেড় প্রায় সাত সেন্টিমিটার। মাথার বেড় আরেকটু বেশি। রেগে ঘাড় ফোলালে ঘাড় ও গলার বেড় বেড়ে যায় কিছুটা। কুচকুচে কালো চোখটা হয়ে যায় ঘোলাটে লালচে। চ্যাপটা ধরনের লেজ, শরীর গোলাকার। শুধু ঘাড় আর মাথা দেখলে কেউটে সাপ বা তেলোটাকির মাথার মতো লাগে। মুখে আছে ছোট ছোট তীক্ষ ধার দাঁত। শরীরের রং হলুদাভ থেকে জলপাই-বাদামি। তার ওপরে ছড়ানো-ছিটানো গাঢ় বাদামি ছিট ছোপ। কম বয়সী মাছের শরীর থাকে দাগহীন। এই মাছের আরো কিছু আঞ্চলিক নাম আছে। যেমন-বামোস, বামুস, বামাস, বামসে, বাউস, বাওস, বানেহারা, বানহরি, বাও বাইম, বাউ বাইম, তেল কোমা, তেল কুমড়া, বাও মাছ, বাউ মাছ। আইইউসিএন এর তথ্য মতে এটি বাংলাদেশের একটি মহাবিপন্ন মাছ। সুনামগঞ্জে ভারত থেকে আগত বিভিন্ন পাহাড়ি নদীতে মাঝে মাঝে এটি পাওয়া যায়।

সরওয়ার, তানভীর ও আমি অনেক চেষ্টা করে মাছটির পরিচয় শনাক্ত করলাম ‘বাওক বাইম’ বলে। তবু সন্দেহ রইল। ছবি পাঠালাম প্রাণিবিদ মনিরুল খানের কাছে। তিনি নিশ্চিত করলেন। মাছটির ইংরেজি নাম Indian Longfin Eel। বৈজ্ঞানিক নাম Anguilla bengalensis। মাছটির আবাসস্থল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ পাহাড়ি সোঁতা, কাপ্তাই লেক, নদী-পুকুর ও বঙ্গোপসাগরসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহের কংস ও সোমেশ্বরী নদী। কংস নদে ধরা পড়া একটি মাছের মাপ ছিল ১১৮০ মিলিমিটার, ওজন ছিল ছয় কেজির বেশি। চরসিন্দুরের দন্তচিকিৎসক ও নেশাদার মাছশিকারি রতন আমাকে জানিয়েছিলেন, তিনি বহুবার বাওক মাছ ধরেছেন, শীতলক্ষ্যায় অনেক আছে। ১৯৮৮ সালে বান্ধব কটন মিলের কেয়ারটেকার তাঁর চিতল মাছ ধরার বঁড়শিতে একটি ১০ কেজি ওজনের বাওক মাছ পেয়েছিলেন। লম্বায় সেটি ছিল সাড়ে চার ফুট। খোঁজখবর নিয়ে আমরা জেনেছি, বাওক মাছ ডাঙায় সর্বোচ্চ আট ঘণ্টা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। শরীরে বিপুল শক্তি ধরে ওরা। ২০০৪ সালের মে মাসে ঘোড়াশাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ও নদীর পার্শ্ববর্তী দুটি সার কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ও উত্তপ্ত পানি শীতলক্ষ্যায় পড়ায় বহু জলজ প্রাণী মরে ভেসে উঠেছিল। ওই দলে ছিল কয়েকটি বাওক বাইমও। সবচেয়ে বড়টির ওজন ছিল পাঁচ কেজি; লম্বায় ছিল চার ফুট তিন ইঞ্চি। ওই সময় জাতীয় দৈনিকগুলোতে সেটির সচিত্র সংবাদ ছাপা হয়েছিল।
আশ্চর্য মাছই বটে বাওক বাইম! এরা বাস করে মিঠাপানিতে, ডিম ছাড়ার সময় সাগরে যায়। ডিম থেকে বাচ্চা হওয়ার পর বাচ্চাগুলো চলে আসে মিঠাপানিতে। ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সে সাগরে গিয়ে আর নাকি ফেরে না। গভীর সমুদ্রে জন্ম। লার্ভা ও শূককীট কয়েক সপ্তাহ সমুদ্রের জলে ভাসার পর তীরভূমির কাছাকাছি আসে। ক্রমে খুদে স্বচ্ছ বান (গ্লাস ইল) থেকে ছোট বাইমে রূপান্তরিত হয়ে নদীতে প্রবেশ করে।
বাওক বাইম শীতলক্ষ্যায় আজও আছে। মাছটি সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণার সুযোগ রয়েছে। তাতে অনেক নতুন তথ্য পাওয়া যাবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।

শরীফ খান | প্রথম আলো
Posted by — Friday, April 29, 2011

Belum ada komentar untuk "বাওক বাইম"

Tambahkan komentar anda :

Advertisement