মাংসাশী প্রানী, মাছ এবং স্কুইড এদের প্রধান খাদ্য।
একসময় বাংলাদেশের খুব কম নদনদীই ছিল যেখানে শুশুক দেখা যেত না। প্রতিকুল পরিবেশ, মানুষের বৈরিতায় আস্তে আস্তে বড় কিছু নদী ছাড়া আর সব জলাশয় থেকেই প্রায় হারিয়ে গেছে ডলফিনের এ প্রজাতি। তার পরও সাম্প্রতিক কিছু জরিপ বলছে, এখনো আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে ডলফিনের সংখ্যা নেহাত কম নয়। বাংলাদেশে ডলফিনের অবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন।
ফারহানা আলম
ডলফিন নিয়ে আলাদা করে কোনো আগ্রহ রুবাইয়াত মনসুর মুগলির ছিল না। তাঁকে আগ্রহী করে তোলেন ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির প্রকল্প পরিচালক ব্রায়ান স্মিথ। ২০০০ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন ভদ্রলোক। বেসরকারি পর্যটন সংস্থা দ্য গাইড ট্যুরস লিমিটেডের ভ্রমণতরীতে করে সুন্দরবন গিয়েছিলেন তিনি। সুন্দরবন যাওয়ার পথে নদীতে শুশুকসহ অনেক ডলফিন দেখলেন ব্রায়ান। ওই অঞ্চলের নদীর পানিতে জলজ স্তন্যপায়ী গোত্রের প্রাণী দেখে গাইড ট্যুরসের মুগলিকে গল্প শোনাতে লাগলেন তিনি। সেই প্রথম মুগলি জানলেন, বাংলাদেশের নদনদী ও বঙ্গোপসাগরে নানা জাতের ডলফিন আছে। গভীর সমুদ্রে আরও আছে ডলফিনেরই জাতভাই তিমি। ব্যস, আর যায় কোথায়! এই বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে শুরু করলেন রুবাইয়াত মুগলি। আর তাঁকে বিভিন্ন সময় সহযোগিতা করার জন্য ব্রায়ান স্মিথ তো ছিলেনই।
২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির জন্য বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, তিমি ও ডলফিন সংরক্ষণ সংস্থা এবং কনভেনশন অন মাইগ্রেটরি স্পিসিজের সমর্থনে মূলত ব্রায়ান স্মিথের আয়োজনে প্রথমবারের মতো শুরু হয় রুবাইয়াতের ডলফিন নিয়ে জরিপের কাজ। জরিপে অংশ নেন ভারত, বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা। জরিপের জন্য তাঁরা ঘুরে বেড়িয়েছেন সুন্দরবনের সব নদী ও খাল। আইইউসিএনের সঙ্গে যৌথভাবে আবার সুন্দরবনের জলপথ ধরে চলে গবেষণা। বাংলাদেশের জলসীমায় থাকা স্তন্যপায়ী প্রাণিবৈচিত্র্যের সন্ধান করা এবং সেগুলো যেন বিলুপ্ত হয়ে না যায় সে লক্ষ্যে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, তার অনুসন্ধানই ছিল রুবাইয়াতের মূল লক্ষ্য।

২০০৪ সালে বাংলাদেশের উপকুল ধরে মিয়ানমারের সীমানা থেকে অর্থাৎ নারিকেল জিঞ্জিরার উপকুল থেকে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের শেষ সীমা পর্যন্ত চালানো হয় আরেকটি জরিপ। এই জরিপেও বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কার ১৫ জন বিজ্ঞানী অংশ নেন। তখনই তাঁরা এই অঞ্চলে সামুদ্রিক ডলফিন ও তিমির দেখা পান। সেই সঙ্গে সুন্দরবনের গভীর সমুদ্রের গিরিখাদ বা অতলস্পর্শে ডলফিনের বৈচিত্র্য ও এদের অবাধ বিচরণ দেখেন।
২০০৫ সালে আবার এ জায়গায় জরিপের সময় তাঁরা প্যানট্রপিক্যাল স্পটেড ডলফিন ও স্পিনার ডলফিনের অস্তিত্ব খুঁজে পান।
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জরিপ চলতে থাকলেও কোনো আনুষ্ঠানিক ভিত্তি না থাকায় রুবাইয়াত ২০০৬ সালের জুলাই মাসে এসে গঠন করেন বাংলাদেশ সেটেশন ডাইভার্সিটি প্রজেক্ট (বিসিডিপি)। রুবাইয়াতও পুরোদমে প্রধান গবেষক হিসেবে কাজ শুরু করেন।
ছয় বছরের জরিপের ফলাফলে মোটামুটি একটা সংখ্যা বের হয়ে এসেছে। গাইড ট্যুরসের ভ্রমণতরী এমভি অবসর, এমভি ছুটি ও এমভি বনবিবির সারেংরাও এই জরিপে অংশ নেন। তাঁরা দল, একক ও বাচ্চা−এই তিনটি ভাগে জরিপটি পরিচালনা করেন। সেই হিসাবমতো শুশুকের এক হাজার পাঁচটি দল, একক এক হাজার ৯৯৩টি এবং বাচ্চা ২৩৫টি গণনা করা হয়। আর ইরাবতী ডলফিনের ২৮১টি দল, একক ৫৬৬টি এবং বাচ্চা ৩২টি দেখা গেছে। এই জরিপ করা হয়েছে সুন্দরবনের সংরক্ষিত ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের ২৬ হাজার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে।
সামগ্রিক জরিপে বাংলাদেশের জলসীমায় প্রায় ছয় হাজার ইরাবতী ডলফিনের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। কিন্তু শুধু অস্তিত্ব থাকলেই হবে না; তাদের অস্তিত্ব যেন বিলুপ্তির দিকে না যায় সেই লক্ষ্যেই কাজ করতে হবে। তাই বিসিডিপি কিছু লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। জনসচেতনতা তৈরি করতে তারা মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে নানা ধরনের বইপত্র, যেখানে ডলফিন ও তিমিবিষয়ক নানা তথ্য দেওয়া আছে। আবার সামাজিকভাবে সংঘবদ্ধ করে আলোচনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। স্থানীয় নেতা এবং স্কুল-কলেজের শিক্ষকেরাও এই সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছেন। খেলাধুলা ও ছবির মাধ্যমেও প্রাণিবৈচিত্র্য সংরক্ষণের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সেই সঙ্গে একটি তথ্যচিত্র জাতীয় গণমাধ্যমে বা স্থানীয়ভাবে দেখানোর ব্যবস্থা করা হবে। জলজ স্তন্যপায়ী আর নিজেদের নিরাপত্তার জন্য জেলেরা যাতে নিরাপদ জলপথ ব্যবহার করতে পারে সেই লক্ষ্যে কম খরচে ও সহজবোধ্য গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনাও আছে। আছে আশপাশের এলাকার গ্রামবাসী ও জেলেদের জলজ স্তন্যপায়ীর বিচরণক্ষেত্র, জীবনাচরণ পর্যালোচনা, প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং সচেতনতা বাড়ানোর পরিকল্পনা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, জলবায়ুর পরিবর্তন, বাঁধের কারণে সুন্দরবন ও মোহনায় নদীর পানির স্বল্পতার মধ্যেও জলজ স্তন্যপায়ীর জীবনধারণ লক্ষ করে এদের বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা।
জলজ স্তন্যপায়ীদের জন্য একটি সংরক্ষিত এলাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে বিসিডিপি। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর আর উত্তরে মংলা বন্দর, পূর্বে বলেশ্বর আর পশ্চিমে পশুর নদকে সীমা ধরে মাঝখানে পূর্ব সুন্দরবনের নির্ধারিত অংশকে এই সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এখানে সংরক্ষিত এলাকায় চিংড়ি মাছের পোনা ধরায় সুক্ষ্মজালের ব্যবহার বন্ধ ও পানিদুষণ রোধ করা গেলেই জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীরা অবাধে বিচরণ করতে পারবে।
জলজ স্তন্যপায়ীর অবাধ বিচরণ ও বৈচিত্র্য বৃদ্ধির লক্ষ্যেই বিসিডিপি ৯ থেকে ১২ অক্টোবর শিশু একাডেমীতে আয়োজন করে বাংলাদেশে প্রথম শুশুক মেলা। চার দিনব্যাপী এই মেলায় বিপুলসংখ্যক দর্শক উপস্থিতি প্রমাণ করে জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণিবৈচিত্র্যের প্রতি মানুষের আগ্রহ আছে। বললেন বিসিডিপির শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সমন্বয়কারী এলিজাবেথ ফাহরনি মনসুর।
ঘুমের মধ্যেও সাঁতার কাটে ডলফিন
বৈচিত্র্যেঘেরা আমাদের এ পৃথিবী। আরো বৈচিত্র্যময় সমুদ্রের তলদেশ। সমুদ্রের তলদেশে কি আছে তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণার অন্ত নেই। স্থলপথে বিজ্ঞানীরা অনেক কিছু আবিষ্কার করলেও সে তুলনায় জলপথে বিজ্ঞানীরা এখনো যোজন যোজন দূরে। সম্প্রতি ইতালির তরুণ গবেষকরা গেনোয়া উপসাগরে ডলফিনের জীবনযাত্রা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চালিয়েছেন। গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। অবাক হলেও সত্য যে, ঘুমের মধ্যেও গোল হয়ে সাঁতার কাটে ডলফিন।
ডলফিন এক চোখ বন্ধ করে ঘুমায়। এরা যখন ঘুমায় তখন এদের মস্তিষ্কের মাত্র অর্ধেক অংশ বিশ্রাম নেয়।
গবেষকরা আরো জানায়, ডলফিন যখন ঘুমায় তখন এরা খুব ধীরে ধীরে সমুদ্রের উপরিভাগে সাঁতার কাটে। এ সময় এরা অনবরত শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করে। ঘুমন্ত ডলফিন এক চোখ খোলা রেখে জোড়ায় জোড়ায় সাঁতার কাটে। এদের মস্তিষ্ক খুবই সতর্ক থাকে। এ সময় একটি চোখ দিয়ে এরা সহযোগীদের সঙ্গে সমন্বয় করে। আরেক প্রকৃতির ডলফিন রয়েছে যারা সাঁতার বন্ধ করে উপরিতলে ব্লোহোলে বিশ্রাম নেয়। ডলফিনের বাচ্চারা সাঁতারের সময় তাদের মায়েদের সঙ্গে বিশ্রামের সুযোগ খুঁজে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছে, এদের ঘুম সংকীর্ণ হওয়ার কারণে কখনো এরা স্বপ্ন দেখতে পারে না। ডলফিন দেখতে খানিকটা তিমির মতো মনে হলেও এদের জীবনযাত্রা অন্যসব প্রাণীর চেয়ে ভিন্ন। শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রক্রিয়াও ভিন্ন প্রকৃতির। মাঝেমধ্যে এরা সমুদ্রের একেবারে উপরিতলে অবস্থান করে। আবার চলে যায় গভীর তলদেশে। ব্লোহোল নামে সমুদ্রে এক ধরনের গর্ত থাকে সেখানে জলজ প্রাণীরা শ্বাস গ্রহণ করতে আসে। ডলফিনও এ ব্লোহালে শ্বাস গ্রহণ করে। ইতালির গেনোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ গবেষক ফোসসরা নেতৃত্বে তার দুই সহকর্মীসহ ডলফিনদের জীবনযাত্রা নিয়ে এ গবেষণা করেছেন। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ও ইতালির উত্তর-পশ্চিমের গেনোয়া উপসাগরের বিভিন্ন জায়গায় গবেষণা চালিয়েছেন গবেষকরা। ইউরোপের সবচেয়ে জনপ্রিয় গেনোয়াজ অ্যাকুরিয়াম। এর পাশের এই উপসাগরে গবেষকরা ডলফিনের গতিবিধি খেয়াল করেছেন, ছবি তুলেছেন এবং তালিকা তৈরি করেছেন। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে ফোস্সা বলেছেন, একটি পূর্ণ বয়স্ক ডলফিন তিন থেকে সাড়ে তিন মিটার হয়ে থাকে এবং বন্দি অবস্থায় এরা বাঁচে প্রায় ৪৫ বছর। যেখানে প্রাকৃতিকভাবে খোলা অবস্থায় বাঁচে আরো ১০ বছর কম। অন্যদিকে প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজেদের রক্ষার ব্যাপারে এগিয়ে আছে স্ত্রী ডলফিনরা। ফোস্সা বলেছেন, ডলফিন যখন ঘুমায় তখনো বৃত্তাকারে সাঁতার কাটতে থাকে। এদের বন্ধ এক চোখ দেখলে মনে হয় মস্তিষ্কের যে অংশটি ঘুম আনে যেন তার প্রতিনিধিত্ব করছে। মানুষের সঙ্গে ডলফিনের সম্পর্কটাও একটা বিশদ গবেষণার বিষয়। মানুষ এদের কাছে সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক। কেননা, একমাত্র মানুষই রাসায়নিক পদার্থ ফেলে পরিবেশকে দূষিত করে ফেলে এবং এদের খাবারের উৎসকে নিঃস্ব করে দেয়। আবার কোনো কোনো মাছের সঙ্গে কিছুটা মিল থাকায় জেলেদের জালেও অনেক সময় উঠতে হয় এদের। আর এসব কারণেই ডলফিনরাও জেলেদের জাল কেড়ে নেয়। তবে সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে যারা বাস করেন তাদের মনে হয় ডলফিনরা পছন্দই করে। এ তথ্য দিয়েছেন ফোস্সা। এখন অবশ্য ডলফিনদের গতিবিধি অনুসরণও করতে পারেন তিনি। বিশেষ করে কয়েকটা ডলফিন তার কাছে এতটাই পরিচিত হয়ে গেছে যে, তিনি এদের নামও রেখেছেন। গেনোয়া অ্যাকুরিয়ামভিত্তিক এই গবেষণা প্রকল্পটির প্রধান গিডো গোনে। তিনি বলেছেন, ডলফিনদের দেখলে মনে হয় এরা সব একইরকম। কিন্তু আপনি যদি কাছ থেকে খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন, এদের ডানা একটার চেয়ে আরেকটার একেবারে আলাদা। ফোসসা ডলফিনের ছবিগুলো পাঠিয়েছেন গোনের কাছে। আর গোন এগুলো নিয়ে একটা আর্কাইভ তৈরি করেছেন। এতে বছরের পর বছর ধরে ডলফিনদের এই গতিবিধি গবেষকরা এখন থেকে জানতে পারবেন।

গেনোয়াস অ্যাকুরিয়ামের ফাইলে এখন তাদের দুইশ চুয়ালি্লশটি নমুনা আছে। দুইটি ডলফিনকে বড় একটা ট্যাংকের মধ্যে পানি দিয়ে রাখা হয়েছে কম বয়সী দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করতে। গোনে বলেন, আমার প্রধান লক্ষ্যই ছিল ডলফিন সম্পর্কে আমাদের সীমিত জ্ঞানকে বাড়ানো, অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নয়।
Belum ada komentar untuk "ডলফিন"
Tambahkan komentar anda :